বড়দের ঘন ঘন জ্বর হওয়ার কারণ সমূহ
জ্বর এমন একটি সাধারণ শারীরিক অবস্থা যা আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কোনো না কোনো সময়ে হয়েছে। ছোট শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ—কেউই জ্বরের বাইরে নয়। বাংলাদেশে আবহাওয়ার তারতম্য, পরিবেশগত পরিবর্তন, খাবারের মান ও জীবনযাত্রার অভ্যাসের কারণে মানুষ প্রায়ই জ্বরে আক্রান্ত হয়। অনেকেই মনে করেন জ্বর আসলে একটি রোগ, কিন্তু আসলে জ্বর কোনো রোগ নয়। এটি মূলত আমাদের শরীরের একটি প্রতিক্রিয়া। শরীরে যখন কোনো সংক্রমণ বা অস্বাভাবিক কিছু ঘটে, তখন শরীর নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এটাই আমরা জ্বর হিসেবে অনুভব করি।
আমাদের দেশে মৌসুমি রোগবালাই খুব বেশি দেখা যায়। বর্ষাকালে ডেঙ্গু, শীতকালে সর্দি-কাশি, গরমকালে হিট স্ট্রোকের মতো সমস্যাগুলো দেখা দেয়। এসব রোগের শুরুতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জ্বর দেখা দেয়। তাই জ্বরকে অবহেলা করা একদমই উচিত নয়। অনেক সময় এটি সাধারণ ভাইরাল জ্বর হতে পারে, আবার কখনো এটি গুরুতর রোগের লক্ষণও হতে পারে।
বিশেষ করে বড়দের ঘন ঘন জ্বর হলে তা অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে দেখা দরকার। কারণ প্রায়শই এটি শরীরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বড় কোনো সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। তবে আতঙ্কিত হওয়ার আগে আমাদের বুঝতে হবে—জ্বর কেন হয়, কীভাবে হয় এবং এর পেছনের আসল কারণ কী।
আজকের এই লেখায় আমি চেষ্টা করব সহজ ভাষায় আপনাকে জানাতে, জ্বর কেন হয়, বড়দের বারবার জ্বর হওয়ার আসল কারণগুলো কী, এবং রাতে হঠাৎ জ্বর কেন আসে। প্রতিটি বিষয়কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে, যাতে আপনি সহজেই বুঝতে পারেন এবং প্রয়োজনে প্রাথমিকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারেন।
জ্বর কেন হয়?

জ্বর আসলে একটি প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। আমাদের শরীরের ভেতরে যখন কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস বা অন্য কোনো জীবাণু ঢুকে যায়, তখন শরীর নিজেকে রক্ষা করার জন্য বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেই শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বেড়ে যায়। সাধারণত মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু সংক্রমণ হলে এই তাপমাত্রা বেড়ে যায়, আর আমরা সেটাকেই জ্বর বলি।
অনেকেই ভাবেন, জ্বর মানেই বিপদ, কিন্তু আসলে জ্বর আমাদের শরীরের একধরনের সতর্ক সংকেত। ধরুন, শরীরে জীবাণু ঢুকল। তখন ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরোধ ক্ষমতা কাজ শুরু করে। শরীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে সেই জীবাণুর কার্যকলাপ কমিয়ে দেয়। অনেক জীবাণু অতিরিক্ত তাপে টিকতে পারে না। তাই শরীর সচেতনভাবে গরম হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পরিবেশগত কারণে জ্বর একটি খুবই সাধারণ সমস্যা। মৌসুমি পরিবর্তনের সময়, যেমন গরম থেকে বৃষ্টি বা শীত থেকে গরমে পরিবর্তনের সময় মানুষ বেশি জ্বরে আক্রান্ত হয়। এ সময়ে হঠাৎ ঠান্ডা লাগা, ভাইরাস ছড়ানো বা পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়া স্বাভাবিক ঘটনা।
শরীরে বিভিন্ন কারণে জ্বর দেখা দিতে পারে। যেমন—সাধারণ সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া বা ইনফ্লুয়েঞ্জা। শুধু তাই নয়, শরীরে প্রদাহ হলে বা যেকোনো অঙ্গের সংক্রমণ ঘটলেও জ্বর হতে পারে। কখনো কখনো মানসিক চাপ বা শরীরের অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকেও শরীরে হালকা জ্বর আসে।
তবে এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জ্বর নিজে কোনো রোগ নয়। বরং জ্বর শরীরের ভেতরে থাকা রোগের একটি লক্ষণ। তাই জ্বর হলে সরাসরি ওষুধ খেয়ে তাপমাত্রা নামিয়ে দেওয়া সবসময় সঠিক উপায় নয়। আসল কারণ খুঁজে বের করা জরুরি।
উদাহরণস্বরূপ, যদি কারো ডেঙ্গু হয় এবং শুধু জ্বর কমানোর ওষুধ খাওয়া হয়, তবে শরীরের ভেতরে আসল সমস্যা থেকেই যাবে। এতে রোগ জটিল হয়ে উঠতে পারে। তাই চিকিৎসকের কাছে গিয়ে আসল কারণ শনাক্ত করা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
এছাড়া ছোট শিশু ও বয়স্কদের জ্বর হলে তা অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক দুর্বল। একইভাবে যাদের ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা বা হার্টের অসুখ আছে, তাদের ক্ষেত্রে জ্বর জটিল আকার নিতে পারে।
সুতরাং বলা যায়, জ্বর একটি প্রয়োজনীয় সংকেত। এটি আমাদের জানিয়ে দেয়, শরীরে কিছু অস্বাভাবিক হচ্ছে। তাই আতঙ্কিত না হয়ে সঠিকভাবে এর কারণ খুঁজে বের করা ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই হলো জ্বরের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় করণীয়।
বড়দের ঘন ঘন জ্বর হওয়ার কারণ সমূহ

বয়স্ক বা বড়দের ঘন ঘন জ্বর হওয়া একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কারণ মাঝে মাঝে ভাইরাল জ্বর আসা স্বাভাবিক হলেও, যদি নিয়মিত বা খুব ঘন ঘন জ্বর হয়, তবে এর পেছনে বড় কোনো কারণ থাকতে পারে। অনেক সময় শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে বা ভেতরে কোনো দীর্ঘস্থায়ী অসুখ থাকলে জ্বর বারবার ফিরে আসে। নিচে বড়দের ঘন ঘন জ্বর হওয়ার ১০টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ তুলে ধরা হলো।
১. ভাইরাল সংক্রমণ
বাংলাদেশে ভাইরাল ফিভার খুবই সাধারণ। মৌসুম পরিবর্তনের সময় ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে প্রথমেই গলা ব্যথা, মাথাব্যথা, শরীরে ব্যথা এবং জ্বর দেখা দেয়। বড়দের ক্ষেত্রে ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সেরে উঠতে সময় বেশি লাগে, তাই একই সময়ে বারবার ভাইরাল জ্বর হতে পারে। ভাইরাসের কারণে শরীর দুর্বল হয়ে যায় এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, ফলে অল্পতেই আবার জ্বরে আক্রান্ত হওয়া সম্ভব। এ জন্য ডাক্তাররা বিশ্রাম নেওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং সঠিক খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন।
২. ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ
ব্যাকটেরিয়ার কারণে সৃষ্ট জ্বর সাধারণ ভাইরাল জ্বরের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়। যেমন—টাইফয়েড, নিউমোনিয়া, টনসিল সংক্রমণ ইত্যাদি। এসব রোগের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া জ্বর সারতে চায় না। টাইফয়েড জ্বর একবার হলে অনেক সময় কয়েক মাস পর আবার হতে পারে। আবার কারো যদি নিউমোনিয়া বা ফুসফুসে সংক্রমণ থাকে, তবে জ্বর বারবার ফিরে আসতে পারে। ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ সাধারণত অবহেলা করলে গুরুতর আকার নেয়। তাই সময়মতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।
৩. প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাওয়া
শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি দুর্বল হয়, তবে মানুষ সহজেই জীবাণুর আক্রমণে আক্রান্ত হয়। যারা দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকেন, বারবার অ্যান্টিবায়োটিক খান, বা অতিরিক্ত মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন, তাদের শরীরে ইমিউনিটি কমে যায়। ইমিউনিটি কমে গেলে হালকা সর্দি থেকেও বড় জ্বর হতে পারে এবং ঘন ঘন জ্বর দেখা দেয়। বাংলাদেশে অপুষ্টি, ভিটামিনের ঘাটতি ও দূষিত খাবার খাওয়ার কারণে অনেকেরই প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে।
৪. ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া
বাংলাদেশে বর্ষাকালে ডেঙ্গু জ্বর এবং কিছু এলাকায় ম্যালেরিয়া একটি সাধারণ রোগ। ডেঙ্গুতে একবার আক্রান্ত হলে শরীর দুর্বল হয়ে যায় এবং দীর্ঘদিন জ্বর আসা-যাওয়া করতে পারে। একইভাবে ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে জ্বর কখনো কখনো সময় মতো আবার ফিরে আসে। বড়দের মধ্যে যদি বারবার জ্বর হয় এবং তার সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখের পিছনে ব্যথা, শরীরে লালচে দাগ ইত্যাদি থাকে, তবে ডেঙ্গু টেস্ট করা জরুরি। আবার যারা সীমান্তবর্তী এলাকায় থাকেন তাদের ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিও বেশি।
৫. টনসিল ও গলা সংক্রমণ
অনেক বড় মানুষ আছেন যাদের গলার সমস্যা প্রায়শই হয়। বারবার গলা ব্যথা বা টনসিল ফুলে যাওয়া থেকে জ্বর দেখা দেয়। গলায় জীবাণু জমে গেলে তা থেকে শরীরে সংক্রমণ ছড়ায়। বিশেষ করে শীতকালে বা ধুলাবালির মৌসুমে এ ধরনের জ্বর বেশি দেখা যায়। কারো যদি ক্রনিক টনসিলের সমস্যা থাকে, তবে তাকে প্রায়ই জ্বরে ভুগতে হয়।
৬. প্রস্রাবের সংক্রমণ (ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন)
বড়দের ঘন ঘন জ্বর হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI)। বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে এ রোগ বেশি হয়। প্রস্রাবে জ্বালা, ঘন ঘন প্রস্রাব লাগা বা কোমরে ব্যথার সঙ্গে জ্বর দেখা দিলে বুঝতে হবে এটি UTI। অনেক সময় রোগী বুঝতেই পারেন না, শুধু জ্বর আসে আর যায়। এ অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজে থেকে ওষুধ খাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে।
৭. দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস রোগীদের শরীরে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। ছোটখাটো ইনফেকশন থেকেও বড় সমস্যা তৈরি হতে পারে। ফলে বারবার জ্বর হওয়া তাদের জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। ডায়াবেটিসে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং ক্ষত সেরে উঠতে দেরি হয়। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের ঘন ঘন জ্বর হলে সেটি অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।
৮. ফুসফুসের রোগ
অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়ার মতো রোগ থাকলে বড়দের বারবার জ্বর হতে পারে। বিশেষ করে ধুলাবালি, ধোঁয়া বা দূষণের কারণে ফুসফুসে প্রদাহ হলে শরীর প্রতিক্রিয়ায় জ্বর সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে বায়ুদূষণ খুব বেশি হওয়ায় এ ধরনের সমস্যা সাধারণ। ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, কাশি ও জ্বর ঘন ঘন দেখা যায়।
৯. হরমোনের সমস্যা বা থাইরয়েড রোগ
শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হলে জ্বর আসা-যাওয়া করতে পারে। বিশেষ করে থাইরয়েডের সমস্যা বা অটোইমিউন রোগে ভোগা ব্যক্তিদের মধ্যে এ ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। অনেক সময় এ ধরনের রোগ নির্ণয় করা কঠিন হয় কারণ লক্ষণগুলো সাধারণ জ্বরের মতো। ফলে রোগী ভেবে নেন এটি সাধারণ সমস্যা, অথচ আসল কারণ থাকে ভিন্ন।
১০. ক্যান্সার বা গুরুতর রোগ
যদিও বিরল, তবে অনেক সময় বড়দের ঘন ঘন জ্বর হওয়ার পেছনে ক্যান্সারের মতো গুরুতর রোগ লুকিয়ে থাকতে পারে। বিশেষ করে লিউকেমিয়া বা রক্তের ক্যান্সারে রোগীরা প্রায়ই জ্বরে আক্রান্ত হন। এ ধরনের জ্বর সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল করে ফেলে। তাই কোনো ব্যক্তির যদি মাসের পর মাস ঘন ঘন জ্বর হয় এবং অন্য কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া না যায়, তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।
রাতে জ্বর আসার কারণ সমূহ

অনেকেই লক্ষ্য করে থাকেন যে দিনের বেলা শরীর স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই বা রাতের দিকে শরীর গরম হয়ে জ্বর আসে। এই অবস্থা অনেককে বিভ্রান্ত করে দেয়। আসলে রাতে জ্বর আসার পেছনে কিছু নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে, যা আমাদের শরীরের প্রাকৃতিক ছন্দ ও ভেতরের সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত।
প্রথমেই বলা দরকার, শরীরের তাপমাত্রা দিনের বিভিন্ন সময়ে ওঠানামা করে। সকালে সাধারণত তাপমাত্রা কম থাকে, আর বিকেল থেকে রাতের দিকে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। যাদের শরীরে কোনো সংক্রমণ আছে, তাদের ক্ষেত্রে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি আরও তীব্রভাবে অনুভূত হয়। তাই দিনের বেলা হালকা মনে হলেও রাতে জ্বরের মাত্রা বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে বিশেষ করে টাইফয়েড জ্বর ও ম্যালেরিয়ার রোগীদের ক্ষেত্রে রাতে জ্বর আসা খুবই সাধারণ ব্যাপার। টাইফয়েডে দিনের বেলা শরীর কিছুটা স্বাভাবিক মনে হলেও সন্ধ্যা বা রাতের দিকে শরীর গরম হয়। একইভাবে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে নির্দিষ্ট সময়ে জ্বর ফিরে আসে, প্রায়ই তা রাতের দিকেই দেখা যায়।
শরীরে যদি লুকানো কোনো ইনফেকশন থাকে, যেমন ফুসফুসে টিবি, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা হাড়ে সংক্রমণ, সেক্ষেত্রেও রাতের দিকে জ্বর আসতে পারে। কারণ রাতে শরীর বিশ্রামে গেলে সংক্রমণ আরও সক্রিয় হয় এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরালোভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়।
অনেক সময় মানসিক চাপ, ঘুমের অভাব বা অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণেও রাতে শরীর গরম হয়ে ওঠে। কারো কারো ক্ষেত্রে এ জ্বর আসলে আসল জ্বর নয়, বরং শরীর ক্লান্তির কারণে গরম হয়ে যায়। তবে প্রকৃত জ্বর আর ক্লান্তির কারণে গরম হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে, যা ডাক্তারের মাধ্যমে বোঝা সম্ভব।
ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রেও অনেক রোগী অভিযোগ করেন যে রাতে শরীর বেশি গরম লাগে এবং জ্বরের মাত্রা বেড়ে যায়। শরীরে পানির ঘাটতি থাকলেও জ্বরের প্রভাব বাড়তে পারে। তাই রাতে জ্বর আসলে পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং শরীর ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করা দরকার।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, রাতে বারবার জ্বর আসা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। এটি শরীরের ভেতরে দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ, টিবি বা হেপাটাইটিসের মতো রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। তাই এই বিষয়টিকে অবহেলা করা একেবারেই উচিত নয়।
যদি কারো রাতে নিয়মিতভাবে জ্বর আসে এবং এর সঙ্গে ওজন কমে যাওয়া, কাশি, ঘাম বা ক্ষুধামন্দার মতো উপসর্গ থাকে, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।
সুতরাং, রাতে জ্বর আসার প্রধান কারণ হলো শরীরের প্রাকৃতিক তাপমাত্রার পরিবর্তন, সংক্রমণের সক্রিয়তা, কিছু বিশেষ রোগ যেমন টাইফয়েড বা ম্যালেরিয়া, এবং শরীরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা দীর্ঘস্থায়ী অসুখ। এই ধরনের জ্বরকে অবহেলা না করে সময়মতো সঠিক পরীক্ষা করানোই বুদ্ধিমানের কাজ।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
বড়দের ঘন ঘন জ্বর হওয়ার কারণ সমূহ” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
ঘন ঘন জ্বর হলে কি তা বিপদের সংকেত?
হ্যাঁ, অবশ্যই। মাঝে মাঝে ভাইরাল জ্বর হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু বারবার জ্বর হলে শরীরের ভেতরে কোনো গুরুতর সমস্যা থাকতে পারে। তাই পরীক্ষা করানো দরকার।
রাতে জ্বর এলে কী করা উচিত?
প্রথমেই শরীর ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করতে হবে, পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে এবং জ্বর যদি নিয়মিত আসে তবে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। এতে আসল কারণ খুঁজে বের করা সহজ হবে।
উপসংহার
জ্বর আমাদের জীবনের একেবারেই সাধারণ একটি অংশ। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এটিকে অবহেলা করা যাবে। আমরা দেখেছি, জ্বর নিজে কোনো রোগ নয়, বরং শরীরের ভেতরে কী ঘটছে তার একটি সংকেত। এটি অনেকটা শরীরের এলার্ম সিস্টেমের মতো। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা যখন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা অন্য কোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে, তখনই জ্বর দেখা দেয়। তাই বলা যায়, জ্বর আমাদের সতর্ক করে দেয় যেন আমরা বুঝতে পারি শরীরে সমস্যা আছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জ্বরের কারণ অনেক বৈচিত্র্যময়। মৌসুমি পরিবর্তন, আবহাওয়ার তারতম্য, দূষিত পানি, নোংরা পরিবেশ, এবং খাবারের মান খারাপ হওয়া—সব মিলিয়ে জ্বর একটি সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা। বিশেষ করে বড়দের ক্ষেত্রে যদি ঘন ঘন জ্বর হয়, তবে এর পেছনে গুরুতর কারণ থাকতে পারে। যেমন—টাইফয়েড, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, টিবি, ডায়াবেটিস, ফুসফুসের রোগ কিংবা ইমিউন সিস্টেমের দুর্বলতা। তাই জ্বর হলে শুধু প্যারাসিটামল খেয়ে বসে থাকা উচিত নয়, বরং কারণ খুঁজে বের করা জরুরি।
রাতে হঠাৎ জ্বর আসার বিষয়টিও আমরা আলোচনা করেছি। অনেক সময় শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা রাতে বেড়ে যায়, তবে এটি যদি নিয়মিত হয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ টিবি বা টাইফয়েডের মতো রোগ প্রায়শই রাতে জ্বর দিয়ে প্রকাশ পায়। আবার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন কিংবা ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী রোগও রাতে জ্বরের কারণ হতে পারে।
তাই জ্বরকে হালকাভাবে দেখা মোটেও উচিত নয়। বরং এটিকে একটি সিগন্যাল হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। নিয়মিত বিশ্রাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান করা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা জ্বর প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জ্বর হলে আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আবার একেবারে অবহেলাও করা ঠিক নয়। সঠিক ভারসাম্য বজায় রেখে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই সঠিক উপায়। বিশেষ করে যদি জ্বর দীর্ঘস্থায়ী হয় বা বারবার ফিরে আসে, তবে অবশ্যই পরীক্ষা করাতে হবে।
শেষ কথা হলো, জ্বরকে আমরা আমাদের শরীরের বন্ধু হিসেবেও দেখতে পারি। কারণ এটি আমাদের সতর্ক করে দেয় যে শরীরের ভেতরে কিছু অস্বাভাবিক চলছে। সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা নিলে জ্বর কোনো বড় সমস্যা নয়। বরং এটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য একটি প্রয়োজনীয় সতর্ক সংকেত।
