ফুটবল খেলার নিয়ম কয়টি ও কি কি?
ফুটবল পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার মধ্যে একটি। বাংলাদেশেও ফুটবল নিয়ে মানুষের আবেগ, ভালোবাসা ও উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। শহর হোক বা গ্রাম, মাঠে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ফুটবল খেলতে দেখা যায় প্রায় সবখানেই। একসময় দেশের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও গ্রামে ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হতো নিয়মিত, যা মানুষকে একত্র করতো। শুধু বিনোদন নয়, ফুটবল শরীর ও মনের জন্যও উপকারী একটি খেলা। খেলতে খেলতে শরীর চর্চা হয়, দৌড়ানো হয়, ফলে শরীর সুস্থ থাকে।
ফুটবল একটি দলীয় খেলা। এখানে প্রতিটি দলের ১১ জন খেলোয়াড় মাঠে নামে। একজন গোলকিপার থাকে, বাকিরা ডিফেন্ডার, মিডফিল্ডার ও ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলে। সবাই মিলে প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠানোই মূল লক্ষ্য। আবার নিজেদের জাল রক্ষাও সমান জরুরি। এই দলগত মানসিকতা খেলোয়াড়দের মধ্যে এক ধরনের শৃঙ্খলা ও সহযোগিতা তৈরি করে।
বাংলাদেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার আগে থেকেই ফুটবল মানুষের কাছে বিনোদনের বড় উৎস ছিল। বিশেষ করে ঢাকার আবাহনী-মোহামেডান খেলার উত্তেজনা ছিল চোখে পড়ার মতো। এখন যদিও ক্রিকেট বেশি জনপ্রিয়, তবুও ফুটবল আজও অনেকের মনে জায়গা করে আছে। বিশ্বকাপ এলে তো পুরো বাংলাদেশ উৎসবের দেশ হয়ে যায়। কেউ ব্রাজিলের সমর্থক, কেউ আর্জেন্টিনার, কেউবা জার্মানির। পতাকা, জার্সি, ব্যানার – সবকিছু ফুটবলকে ঘিরেই চলে।
ফুটবলের ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। এটি শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ডে। তারপর ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ফিফা নামক আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্ব ফুটবল পরিচালনা করে। বিশ্বকাপ ফুটবল চার বছর পর পর হয়, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর হিসেবে পরিচিত। কোটি কোটি মানুষ টিভি কিংবা অনলাইনে খেলা দেখে। বাংলাদেশের মানুষও সারা রাত জেগে খেলা উপভোগ করে।
ফুটবল শুধু খেলা নয়, এটি একটি সংস্কৃতির অংশ। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ – সবাই এই খেলায় আনন্দ খুঁজে নেয়। অনেক তরুণ ফুটবলকে পেশা হিসেবে নিতে চায়। যদিও আমাদের দেশে অবকাঠামোগত কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, তবে প্রতিভার কোনো অভাব নেই। সঠিক প্রশিক্ষণ ও সুযোগ পেলে বাংলাদেশ থেকেও বড় ফুটবলার তৈরি হতে পারে।
ফুটবল খেলতে বিশেষ কোনো ব্যয়বহুল সরঞ্জামের দরকার হয় না। একটি বল থাকলেই খেলাটি শুরু করা যায়। এ কারণেই এটি দরিদ্র দেশেও সমান জনপ্রিয়। মাঠ ছোট হোক বা বড়, গলিপথ হোক বা স্কুলের মাঠ – যেখানে জায়গা পাওয়া যায়, সেখানেই খেলা শুরু হয়ে যায়। এই সহজলভ্যতাই ফুটবলকে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী করেছে।
আমাদের দেশের জন্য ফুটবল নতুন প্রজন্মকে সুস্থ বিনোদনে যুক্ত করার একটি বড় মাধ্যম। বর্তমানে অনেক স্কুল-কলেজে ফুটবল প্রতিযোগিতা হয়, যা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি মানসিক আনন্দ দেয়। তরুণরা খেলার মাধ্যমে শিখে টিমওয়ার্ক, ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাস।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ফুটবল শুধু একটি খেলা নয়, এটি আনন্দ, সুস্থতা, ঐক্য ও উৎসবের প্রতীক। বাংলাদেশে যেমন এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে, তেমনি বিশ্বব্যাপীও এটি কোটি মানুষের হৃদয়ের খেলা। এই খেলায় আছে শৃঙ্খলা, প্রতিযোগিতা এবং সবচেয়ে বড় কথা – মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগের শক্তি।
ফুটবল সম্পর্কে তথ্য সংক্ষিপ্ত

ফুটবল একটি বৈশ্বিক খেলা, যার ইতিহাস বহু পুরনো। আজকের আধুনিক ফুটবল ইংল্যান্ডে নিয়মিতভাবে শুরু হলেও এর শিকড় অনেক দেশের প্রাচীন খেলাধুলায় পাওয়া যায়। ফুটবলে প্রতিটি দলে ১১ জন খেলোয়াড় থাকে এবং খেলাটি সাধারণত ৯০ মিনিট স্থায়ী হয়। দুই অর্ধে ভাগ করা হয়—প্রতিটি অর্ধ ৪৫ মিনিট। মাঝখানে থাকে ১৫ মিনিট বিরতি। খেলার মূল উদ্দেশ্য হলো বলকে প্রতিপক্ষের জালে প্রবেশ করানো এবং বেশি গোল করা।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া সংস্থা ফিফা ফুটবল পরিচালনা করে। প্রতি চার বছর পর ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজন করে, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট। এই বিশ্বকাপে বিশ্বের নানা দেশের সেরা দলগুলো অংশগ্রহণ করে। কোটি কোটি দর্শক টিভি এবং অনলাইনে খেলা উপভোগ করে। শুধু বিশ্বকাপ নয়, উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, কোপা আমেরিকা, এশিয়ান কাপসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাও ফুটবলকে আরও জনপ্রিয় করেছে।
বাংলাদেশে ফুটবলের ইতিহাসও গৌরবময়। স্বাধীনতার পর থেকে ফুটবল এখানে মানুষের আবেগের বড় জায়গা দখল করেছে। ঢাকা মোহামেডান ও আবাহনীর খেলা নিয়ে মানুষ যে উত্তেজনায় থাকত, তা দেশের খেলাধুলার ইতিহাসে অনন্য। আজও গ্রামে-গঞ্জে স্কুল, কলেজ বা স্থানীয় টুর্নামেন্টে ফুটবল খেলার উৎসাহ দেখা যায়। ক্রিকেটের উত্থানের পরেও ফুটবলের আবেদন কমেনি। বিশেষ করে বিশ্বকাপ এলে পুরো দেশ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়—ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকরা পতাকা, জার্সি, পোস্টার নিয়ে উৎসব করে।
ফুটবল খেলতে বিশেষ কোনো খরচ লাগে না। শুধু একটি বল থাকলেই খেলা শুরু করা যায়। তাই এটি গ্রাম-শহর সব জায়গায় সমান জনপ্রিয়। ফুটবল খেলা শরীরের জন্যও উপকারী। দৌড়ানো, বল কন্ট্রোল করা এবং কৌশল প্রয়োগ করার মাধ্যমে শরীর চর্চা হয়, পেশি শক্ত হয় এবং হৃদযন্ত্র সুস্থ থাকে। তরুণদের জন্য এটি মানসিক প্রশান্তিরও বড় উৎস।
ফুটবলে খেলোয়াড়দের মধ্যে থাকে গোলকিপার, ডিফেন্ডার, মিডফিল্ডার এবং ফরোয়ার্ড। প্রত্যেকের আলাদা দায়িত্ব থাকলেও দলগতভাবে কাজ না করলে খেলার সাফল্য আসে না। এ কারণেই ফুটবলকে দলীয় খেলার সেরা উদাহরণ বলা হয়। এই খেলায় শৃঙ্খলা, সহযোগিতা, ধৈর্য এবং কৌশলের সমন্বয় করতে হয়।
বিশ্বব্যাপী ফুটবলের জনপ্রিয়তা অন্য যেকোনো খেলার চেয়ে বেশি। টিভি দর্শকসংখ্যা, স্টেডিয়ামের ভিড়, স্পন্সরশিপ এবং খেলোয়াড়দের জনপ্রিয়তা ফুটবলকে শীর্ষস্থানে রেখেছে। বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় যেমন লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বা নেইমার কেবল খেলোয়াড় নন, তারা কোটি ভক্তের অনুপ্রেরণা। তাদের খেলা মানুষকে আনন্দ দেয়, একইসাথে নতুন প্রজন্মকে খেলায় অংশ নিতে উৎসাহিত করে।
সব দিক মিলিয়ে বলা যায়, ফুটবল একটি সর্বজনীন খেলা। এটি মানুষকে একত্র করে, আনন্দ দেয়, সুস্থ রাখে এবং জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে ফুটবল শুধু একটি খেলা নয়, এটি আবেগ, ঐক্য এবং ভালোবাসার প্রতীক।
ফুটবল খেলার নিয়ম কয়টি ও কি কি?

ফুটবল খেলার কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে মানা হয়। এই নিয়মগুলো মূলত ফিফা নির্ধারণ করেছে এবং সারা বিশ্বে একইভাবে কার্যকর থাকে। নিয়ম না মানলে খেলা বিশৃঙ্খল হয়ে যাবে, তাই প্রতিটি খেলোয়াড়কে নিয়মগুলো জানতে হয় এবং মেনে চলতে হয়। সাধারণত ফুটবল খেলার মূল নিয়ম ১৭টি, তবে সহজভাবে আমরা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলাদা করে দেখতে পারি। নিচে ১০টি প্রধান নিয়ম বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো-
১. খেলোয়াড়ের সংখ্যা
ফুটবলে প্রতিটি দলে সর্বোচ্চ ১১ জন খেলোয়াড় মাঠে থাকতে পারে। এর মধ্যে একজন গোলরক্ষক বাধ্যতামূলক। খেলোয়াড় সংখ্যা যদি ৭ জনের কম হয়ে যায়, তবে দলটি খেলা চালিয়ে যেতে পারে না। বাংলাদেশের স্থানীয় টুর্নামেন্টগুলোতেও এই নিয়ম মানা হয়। খেলোয়াড় সংখ্যা সঠিক থাকলেই খেলা প্রতিযোগিতামূলক হয় এবং উভয় দলের জন্য ন্যায্য হয়।
২. খেলার সময়
একটি পূর্ণাঙ্গ ফুটবল ম্যাচ ৯০ মিনিটের হয়ে থাকে। এটি দুই ভাগে বিভক্ত – প্রথমার্ধ ৪৫ মিনিট এবং দ্বিতীয়ার্ধ ৪৫ মিনিট। মাঝখানে ১৫ মিনিট বিরতি দেওয়া হয়। রেফারি অতিরিক্ত সময় যোগ করতে পারেন যদি খেলার মধ্যে ইনজুরি, সময় নষ্ট বা অন্য কোনো কারণে খেলা থেমে যায়। বাংলাদেশের স্থানীয় মাঠে সময় অনেক সময় কমিয়ে খেলা হয়, তবে আন্তর্জাতিকভাবে ৯০ মিনিটই নিয়ম।
৩. খেলার শুরু ও পুনরারম্ভ
খেলা শুরুর সময় বল মাঠের মাঝখানে রাখা হয় এবং কিক অফ দিয়ে খেলা শুরু হয়। একইভাবে যখন একটি গোল হয় বা খেলা দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হয়, তখনও কিক অফ হয়। যদি বল মাঠের বাইরে চলে যায়, তবে থ্রো-ইন, কর্নার কিক বা গোল কিক দিয়ে খেলা পুনরায় শুরু হয়। নিয়ম মেনে শুরু না হলে রেফারি খেলা বন্ধ করে পুনরায় শুরু করতে পারেন।
৪. গোল করার নিয়ম
গোল গণনা করার জন্য বলকে সম্পূর্ণভাবে গোলপোস্টের ভেতর দিয়ে গোললাইন অতিক্রম করতে হয়। শুধু আংশিকভাবে গোললাইন পার হলে গোল হিসেবে গণ্য হবে না। অনেক সময় খেলোয়াড়রা ভেবেই নেন যে বল গোলপোস্টে ঢুকেছে, কিন্তু রেফারির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল লাইন টেকনোলজি ব্যবহার করা হয় সঠিকভাবে গোল শনাক্ত করার জন্য।
৫. বল খেলার ভেতরে ও বাইরে
বল যদি পুরোপুরি গোললাইন বা টাচলাইন পার হয়ে যায়, তখন সেটি মাঠের বাইরে বলে গণ্য হবে। যতক্ষণ বল মাঠের সীমানার ভেতরে থাকে, ততক্ষণ খেলা চলতে থাকবে। অনেক সময় দেখা যায় খেলোয়াড়রা থেমে যায়, কিন্তু বল এখনো মাঠের ভেতরে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী বল পুরোপুরি বাইরে না গেলে খেলা বন্ধ হয় না।
৬. অফসাইড নিয়ম
অফসাইড ফুটবলের একটি জটিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম। যদি কোনো খেলোয়াড় প্রতিপক্ষের শেষ ডিফেন্ডারের সামনে থেকে বল পায় এবং তখন সে সক্রিয়ভাবে খেলায় যুক্ত থাকে, তবে সেটি অফসাইড ধরা হয়। এই নিয়ম ছাড়া হলে ফরোয়ার্ডরা সবসময় গোলপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত এবং খেলা ভারসাম্য হারাত। অফসাইডের কারণে অনেক গোল বাতিল হয়, যা খেলায় উত্তেজনা বাড়ায়।
৭. ফাউল এবং অসদাচরণ
খেলোয়াড়রা যদি প্রতিপক্ষকে ধাক্কা দেয়, টেনে ধরে, পা লাগায় বা হাত দিয়ে বল নিয়ন্ত্রণ করে, তবে সেটি ফাউল হিসেবে গণ্য হয়। এছাড়া রেফারিকে অসম্মান করা, অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করাও অসদাচরণ। এসবের জন্য ফ্রি কিক, পেনাল্টি কিক বা কার্ড দেখানো হতে পারে। বাংলাদেশি মাঠেও ফাউল নিয়ে অনেক সময় বিতর্ক হয়, তবে নিয়ম সবার জন্য সমান।
৮. ফ্রি কিক
ফাউলের কারণে প্রতিপক্ষ দল ফ্রি কিক পায়। ফ্রি কিক দুই ধরনের হতে পারে – সরাসরি (ডাইরেক্ট) এবং পরোক্ষ (ইনডাইরেক্ট)। সরাসরি ফ্রি কিক থেকে সরাসরি গোল করা যায়, কিন্তু পরোক্ষ ফ্রি কিকে আগে বলকে অন্য খেলোয়াড়ের ছোঁয়া লাগতে হয়। এই নিয়ম খেলায় ভারসাম্য আনে।
৯. পেনাল্টি কিক
যদি কোনো খেলোয়াড় নিজ দলের পেনাল্টি বক্সের ভেতর ফাউল করে, তবে প্রতিপক্ষ দল পেনাল্টি কিক পায়। গোলপোস্ট থেকে ১১ মিটার দূরে থেকে এটি নেওয়া হয়। একে একে খেলোয়াড় ও গোলরক্ষকের দ্বন্দ্ব হয় এখানে। অনেক বড় ম্যাচের ফল পেনাল্টি কিক দিয়েই নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশের স্থানীয় খেলাতেও পেনাল্টি শুটআউট বেশ জনপ্রিয়।
১০. থ্রো-ইন, কর্নার কিক ও গোল কিক
যদি বল সাইড লাইনের বাইরে যায়, তবে যে দলের খেলোয়াড় শেষবার স্পর্শ করেনি সেই দল থ্রো-ইন নিতে পারে। যদি বল গোললাইন অতিক্রম করে এবং প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় শেষবার স্পর্শ করে, তবে কর্নার কিক দেওয়া হয়। আবার যদি নিজের দলের খেলোয়াড় শেষবার স্পর্শ করে এবং গোল না হয়, তবে গোল কিক দেওয়া হয়। এগুলো ফুটবলের খুব সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম।
ফুটবল খেলার মাঠের বিভিন্ন অংশের নাম

ফুটবল খেলার জন্য নির্দিষ্ট আকার ও নিয়মে তৈরি মাঠ ব্যবহার করা হয়। একটি আন্তর্জাতিক মানের ফুটবল মাঠের দৈর্ঘ্য সাধারণত ১০০ থেকে ১১০ মিটার এবং প্রস্থ ৬৪ থেকে ৭৫ মিটার হয়ে থাকে। মাঠটি আয়তাকার হয় এবং সবুজ ঘাসে ঢাকা থাকে। মাঠের প্রতিটি অংশের আলাদা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। একজন খেলোয়াড়ের জন্য এই অংশগুলো ভালোভাবে জানা খুবই জরুরি, কারণ প্রতিটি এলাকার ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম এবং ব্যবহার আছে।
প্রথমত, মাঠের চারপাশে থাকে টাচলাইন এবং গোললাইন। টাচলাইন হলো মাঠের লম্বালম্বি দিকের সীমানা, আর গোললাইন হলো মাঠের প্রস্থের দিকের সীমানা। খেলার সময় যদি বল এই লাইন অতিক্রম করে, তবে খেলা থেমে যায় এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী থ্রো-ইন, কর্নার কিক বা গোল কিক হয়।
দ্বিতীয়ত, মাঠের মাঝখানে থাকে সেন্টার সার্কেল। এখান থেকেই খেলা শুরু হয় এবং গোল হওয়ার পর পুনরায় খেলা শুরু করার নিয়মও এখান থেকে। সেন্টার সার্কেলের চারপাশের বৃত্তাকার অংশ খেলোয়াড়দের সঠিক দূরত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে।
তৃতীয়ত, প্রতিটি প্রান্তে থাকে পেনাল্টি এরিয়া। এটি গোলপোস্টের সামনে চিহ্নিত একটি বড় বক্সের মতো এলাকা। এই এলাকায় যদি ডিফেন্ডাররা কোনো ফাউল করে, তবে প্রতিপক্ষ দল পেনাল্টি কিক পায়। এছাড়া গোলকিপার কেবল এই এলাকাতেই হাতে বল ধরতে পারে। তাই পেনাল্টি এরিয়া খেলায় সবচেয়ে সংবেদনশীল জায়গা।
চতুর্থত, পেনাল্টি এরিয়ার ভেতরে থাকে গোল এরিয়া বা ছোট বক্স। এখান থেকে গোলকিপার গোল কিক নেয়। এই জায়গাটি গোলপোস্টের একেবারে সামনে থাকে বলে প্রতিপক্ষ ফরোয়ার্ডদের জন্য এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, কারণ এখানেই গোল করার সুযোগ সবচেয়ে বেশি তৈরি হয়।
পঞ্চমত, মাঠের দুই প্রান্তে থাকে কর্নার এরিয়া। প্রতিটি কর্নারে একটি করে ছোট আর্ক বা বৃত্ত আঁকা থাকে। বল যদি গোললাইন অতিক্রম করে কিন্তু গোল না হয় এবং ডিফেন্ডার শেষবার বল স্পর্শ করে, তবে কর্নার কিক এখান থেকে নেওয়া হয়। কর্নার কিক ফুটবলের অন্যতম উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত তৈরি করে।
ষষ্ঠত, মাঠের দুই পাশে থাকে টাচলাইন বরাবর জায়গা, যেখান থেকে থ্রো-ইন নেওয়া হয়। থ্রো-ইনের জন্য খেলোয়াড়কে দুই হাত দিয়ে মাথার ওপরে থেকে বল ছুড়ে দিতে হয় এবং দুই পা মাটিতে রাখতে হয়।
সপ্তমত, মাঠের প্রতিটি প্রান্তে থাকে গোলপোস্ট। গোলপোস্ট হলো খেলার মূল লক্ষ্য, যেখানে বল প্রবেশ করানোই হলো গোল। গোলপোস্টের উচ্চতা ২.৪৪ মিটার এবং প্রস্থ ৭.৩২ মিটার। গোলপোস্টে নেট লাগানো থাকে যাতে বল ঢুকলেই স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
অষ্টমত, মাঠে থাকে হাফওয়ে লাইন, যা মাঠকে সমান দুইভাগে ভাগ করে। খেলার শুরুতে প্রতিটি দল নিজেদের অর্ধে দাঁড়ায়। এই লাইনই নির্দেশ করে কোন অংশে কোন দলের নিয়ন্ত্রণ বেশি।
নবমত, পেনাল্টি এরিয়ার ভেতরে থাকে পেনাল্টি স্পট। এটি গোললাইন থেকে ১১ মিটার দূরে একটি ছোট গোল চিহ্ন, এখান থেকেই পেনাল্টি কিক নেওয়া হয়।
সবশেষে বলা যায়, ফুটবল মাঠের প্রতিটি অংশ খেলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। মাঠের এই বিভাজন খেলোয়াড়দের কৌশল নির্ধারণে সাহায্য করে এবং খেলা সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে অনেক মাঠ আন্তর্জাতিক মানের না হলেও, প্রতিটি মাঠেই এই মৌলিক অংশগুলো থাকে। ফলে খেলোয়াড়রা সহজেই নিয়ম মেনে খেলা চালাতে পারে।
ফুটবলের ফাউল কত প্রকার ও কি কি?
ফুটবল খেলার নিয়ম মেনে খেলতে হয়। তবে খেলোয়াড়রা অনেক সময় ইচ্ছা করে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে নিয়ম ভঙ্গ করে বসে। একে বলা হয় ফাউল। ফাউল হলে রেফারি খেলা থামিয়ে দেন এবং প্রতিপক্ষ দলকে সুবিধা দেন—যেমন ফ্রি কিক, পেনাল্টি কিক বা কখনও কখনও হলুদ বা লাল কার্ড দেখান। আন্তর্জাতিকভাবে ফুটবলে ফাউলের ধরন নানা রকম হলেও মূলত ১০টির মতো সাধারণ ফাউল সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। নিচে ১০টি সাধারণ ফাউলের ধরন ও তাদের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলো।
১. হ্যান্ডবল ফাউল
যদি কোনো খেলোয়াড় ইচ্ছাকৃতভাবে হাত বা বাহু দিয়ে বল স্পর্শ করে, তবে সেটি হ্যান্ডবল ফাউল হিসেবে গণ্য হয়। কেবল গোলরক্ষক তার পেনাল্টি এরিয়ার ভেতরে হাত ব্যবহার করতে পারে। মাঠের খেলোয়াড়রা বল হাতে ধরলে প্রতিপক্ষ দল ফ্রি কিক বা পেনাল্টি কিক পায়। বাংলাদেশি মাঠেও এ ধরনের ফাউল প্রায়ই দেখা যায়।
২. ট্রিপিং বা হোঁচট খাওয়ানো
প্রতিপক্ষকে ইচ্ছাকৃতভাবে পা লাগিয়ে ফেলে দেওয়া বা হোঁচট খাওয়ানো ট্রিপিং ফাউল। খেলোয়াড়রা প্রায়ই বল কেড়ে নিতে গিয়ে এ ধরনের কাজ করে থাকে। এতে প্রতিপক্ষ আহত হতে পারে এবং খেলার গতি নষ্ট হয়। রেফারি এ ধরনের ফাউল দেখলে সঙ্গে সঙ্গে বাঁশি বাজান।
৩. হোল্ডিং বা টেনে ধরা
যদি কোনো খেলোয়াড় প্রতিপক্ষকে জোর করে টেনে ধরে বা জার্সি ধরে খেলার গতি আটকায়, তবে এটি হোল্ডিং ফাউল। এটি খেলায় খুবই সাধারণ। বিশেষ করে ডিফেন্ডাররা ফরোয়ার্ডদের থামানোর জন্য জার্সি টানতে পারে। এটি খেলাধুলার চেতনার বিরুদ্ধে।
৪. চার্জিং বা জোরে ধাক্কা দেওয়া
খেলোয়াড়রা অনেক সময় প্রতিপক্ষকে ধাক্কা দিয়ে বল দখল করতে চায়। যদি এটি নিয়মের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত জোরে হয়, তবে সেটি ফাউল হয়। বল দখলের সময় শরীর ব্যবহার করা যায়, তবে তা নিয়ম মেনে হতে হবে। বাংলাদেশি ফুটবলে এই ধরনের ফাউল প্রচুর ঘটে।
৫. ডেঞ্জারাস প্লে বা বিপজ্জনক খেলা
খেলোয়াড় যদি এমনভাবে খেলে যাতে অন্য খেলোয়াড় আঘাত পেতে পারে, তবে সেটি বিপজ্জনক খেলা ধরা হয়। যেমন খুব উঁচুতে পা তুলে বল মারতে গিয়ে প্রতিপক্ষের মাথায় আঘাত করার আশঙ্কা থাকলে রেফারি এটিকে ফাউল ঘোষণা করেন। খেলোয়াড়দের সুরক্ষার জন্য এই নিয়মটি গুরুত্বপূর্ণ।
৬. অফ দ্য বল ফাউল
বল না থাকার সময় প্রতিপক্ষকে ধাক্কা দেওয়া, মারধর করা বা ঠেলাঠেলি করা অফ দ্য বল ফাউল। অনেক সময় রেফারি বলের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তখন খেলোয়াড়রা এ ধরনের ফাউল করে। তবে সহকারী রেফারি বা ক্যামেরার কারণে এখন এ ধরনের ফাউল ধরা পড়ে যায়।
৭. স্পিটিং বা থুথু নিক্ষেপ
খেলোয়াড় যদি প্রতিপক্ষ বা রেফারির দিকে থুথু নিক্ষেপ করে, তবে এটি গুরুতর ফাউল। এটি শুধু অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ নয়, বরং অসম্মানজনকও। এ ধরনের ফাউলে সাধারণত সরাসরি লাল কার্ড দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক ম্যাচে এই ধরনের ঘটনা হলে কঠোর শাস্তি হয়।
৮. রেফারির সঙ্গে দুর্ব্যবহার
খেলোয়াড়রা যদি রেফারিকে অসম্মান করে, অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে বা ইচ্ছাকৃতভাবে সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে, তবে সেটিও ফাউল হিসেবে গণ্য হয়। রেফারির সিদ্ধান্ত সর্বশেষ এবং চূড়ান্ত। তাই তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে খেলোয়াড়কে হলুদ বা লাল কার্ড দেখানো হয়।
৯. হ্যান্ড টু ফেস বা আঘাত করা
কখনো খেলোয়াড়রা রাগের মাথায় প্রতিপক্ষকে ঘুষি বা কনুই মারতে পারে। এটি গুরুতর ফাউল এবং সরাসরি লাল কার্ড পাওয়ার মতো অপরাধ। ফুটবল একটি শারীরিক খেলা হলেও এখানে মারধরের কোনো স্থান নেই। বাংলাদেশের স্থানীয় খেলায়ও অনেক সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটে।
১০. অফসাইড সম্পর্কিত ফাউল
অফসাইড নিয়ম ভঙ্গ করলে সেটিও এক ধরনের ফাউল ধরা হয়। যখন কোনো খেলোয়াড় প্রতিপক্ষের শেষ ডিফেন্ডারের সামনে থেকে বল পায় এবং তখন সক্রিয়ভাবে খেলায় অংশ নেয়, তখন তাকে অফসাইড ঘোষণা করা হয়। যদিও অনেকেই এটি নিয়ে বিভ্রান্ত থাকে, তবুও এটি খেলার গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
“ফুটবল খেলার নিয়ম কয়টি ও কি কি?” এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
ফুটবল খেলার জন্য কতজন খেলোয়াড় প্রয়োজন?
ফুটবল খেলার জন্য প্রতিটি দলে সর্বোচ্চ ১১ জন খেলোয়াড় থাকতে হয়। এর মধ্যে একজন গোলরক্ষক বাধ্যতামূলক। যদি কোনো কারণে খেলোয়াড় সংখ্যা ৭ জনের কম হয়ে যায়, তবে খেলা চালানো সম্ভব হয় না।
ফুটবলে ফাউল করলে কী ধরনের শাস্তি হতে পারে?
ফাউল করলে রেফারি খেলা থামিয়ে প্রতিপক্ষকে সুবিধা দেন। শাস্তি হিসেবে ফ্রি কিক, পেনাল্টি কিক, হলুদ কার্ড বা লাল কার্ড দেখানো হতে পারে। ফাউলের ধরন অনুযায়ী শাস্তির মাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
উপসংহার
ফুটবল শুধু একটি খেলা নয়, এটি মানুষের আবেগ, ঐক্য আর আনন্দের প্রতীক। সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় খেলা হিসেবে ফুটবল কোটি কোটি মানুষের মন জয় করেছে। মাঠের প্রতিটি নিয়ম, প্রতিটি কৌশল, প্রতিটি ফাউল খেলাটিকে আরও নিয়মতান্ত্রিক এবং রোমাঞ্চকর করে তোলে। একজন খেলোয়াড় বা দর্শক হিসেবে যদি আমরা নিয়মগুলো ভালোভাবে জানি, তবে খেলার প্রতিটি মুহূর্ত আরও উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশেও ফুটবলের প্রতি মানুষের ভালোবাসা অবর্ণনীয়। গ্রাম থেকে শহর, ছোট টুর্নামেন্ট থেকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা—সবখানেই ফুটবল সমানভাবে আকর্ষণ তৈরি করে। বিশ্বকাপ এলে দেশ যেন উৎসবে মেতে ওঠে। ফুটবল খেলা শুধু শরীরকে সুস্থ রাখে না, বরং মানসিক প্রশান্তি দেয় এবং দলগতভাবে কাজ করার শিক্ষা দেয়।
খেলার মাঠে শৃঙ্খলা, কৌশল, সহনশীলতা আর সহযোগিতা—এই সবকিছু ফুটবল আমাদের জীবনে শেখায়। মাঠের নিয়ম না মানলে যেমন খেলা সুন্দর হয় না, তেমনি জীবনের নিয়ম না মানলেও আমরা সফল হতে পারি না। তাই ফুটবল শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি জীবনবোধেরও প্রতিফলন।
সবশেষে বলা যায়, ফুটবল এমন একটি খেলা যা পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষকে এক সুতোয় গেঁথে রাখে। এটি সীমান্ত, ভাষা বা সংস্কৃতির বাধা মানে না। একটি বল, একটি মাঠ আর কিছু খেলোয়াড়ই যথেষ্ট আনন্দের স্রোত বইয়ে দিতে। বাংলাদেশে ফুটবলের ঐতিহ্য নতুন প্রজন্মকে আবারো ফুটবলে আগ্রহী করবে—এমনটাই প্রত্যাশা।
