মেলানোমা স্কিন ক্যান্সার এর লক্ষণ?
ত্বক আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড় অঙ্গ, যা প্রতিদিন সূর্যের আলো, দূষণ এবং নানা রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসে। কখনো কখনো এই দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির ফলে ত্বকের কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় এবং গঠন করে স্কিন ক্যান্সার। এর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ও মারাত্মক ধরন হলো মেলানোমা স্কিন ক্যান্সার। এটি মূলত মেলানোসাইট নামক কোষ থেকে তৈরি হয়, যেগুলো ত্বকের রঙ তৈরি করে।
বাংলাদেশের গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া, সূর্যের তীব্র রশ্মি, এবং সঠিক সানপ্রটেকশন না নেওয়ার কারণে অনেকেই অজান্তে এই রোগের ঝুঁকিতে পড়েন। প্রথম দিকে এটি সাধারণ তিল বা দাগের মতো দেখা যায়, তাই অনেকেই গুরুত্ব দেন না। কিন্তু সময়মতো চিকিৎসা না নিলে এটি শরীরের অন্য অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা জীবনকে বিপন্ন করে তোলে।
মেলানোমা সাধারণত মুখ, ঘাড়, বাহু, পা বা শরীরের সূর্যালোক-প্রাপ্ত জায়গায় বেশি দেখা যায়, তবে কখনো শরীরের লুকানো অংশেও হতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে এর চিকিৎসা সম্ভব এবং সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়াও যায়। তাই এই ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো জানা, নিয়মিত ত্বক পরীক্ষা করা এবং সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি।
এই ব্লগে আমরা বিস্তারিতভাবে জানব—মেলানোমা স্কিন ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কী, কিভাবে চিনবেন, এবং কোন বিষয়গুলো আপনাকে সতর্ক করবে।
মেলানোমা স্কিন ক্যান্সার এর লক্ষণ?
মেলানোমা মূলত ত্বকের কোনো দাগ, তিল বা নতুন স্পটের পরিবর্তনের মাধ্যমে চিহ্নিত হয়। এটি সাধারণত ABCDE নিয়মে বোঝা যায়—Asymmetry, Border, Color, Diameter, Evolving। তবে এর বাইরেও আরও অনেক সতর্কতার বিষয় আছে। নিচে মেলানোমার ১০টি সাধারণ লক্ষণ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো।
১. তিলের আকার বা আকৃতির পরিবর্তন
মেলানোমা সাধারণত পুরনো তিলের পরিবর্তনের মাধ্যমে শুরু হয়। যদি কোনো তিলের একটি দিক বড় বা অসমান হয়ে যায়, তাহলে সেটি হতে পারে ক্যান্সারের প্রাথমিক ইঙ্গিত। তিলের প্রান্ত অস্পষ্ট, খসখসে বা ফুলে উঠলে তা অবহেলা করা উচিত নয়।
বাংলাদেশে অনেকেই ছোটখাটো তিল বা দাগকে গুরুত্ব দেন না। কিন্তু চিকিৎসকরা বলেন, তিলের আকৃতিতে হঠাৎ পরিবর্তন মানেই সতর্ক হওয়ার সময়। বিশেষ করে যদি সেটি ৬ মিলিমিটারের বেশি হয় বা সময়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে, তাহলে দ্রুত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া দরকার।
২. ত্বকের রঙে অস্বাভাবিক দাগ
যদি ত্বকে কালো, বাদামী, লাল, নীল বা সাদা দাগ একসঙ্গে দেখা যায়, তাহলে সেটি হতে পারে মেলানোমার প্রাথমিক রূপ। অনেক সময় রঙের তারতম্যই রোগের অগ্রগতি বোঝায়।
বাংলাদেশের উষ্ণ আবহাওয়ায় সূর্যের আলোতে কাজ করা মানুষদের মধ্যে এই ধরনের দাগ দেখা যায় বেশি। তাই যারা প্রতিদিন সূর্যের নিচে কাজ করেন (যেমন কৃষক, নির্মাণশ্রমিক), তাদের নিয়মিত ত্বক পরীক্ষা করা উচিত।
৩. তিল বা দাগ থেকে রক্তপাত বা খোসা ওঠা
যদি কোনো তিল বা দাগ হঠাৎ করে রক্তপাত শুরু করে বা খোসা ওঠে, সেটি ক্যান্সারের সতর্ক সংকেত হতে পারে। এটি তখনই হয় যখন কোষগুলো অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে ত্বকের উপরের স্তর নষ্ট করে ফেলে।
অনেকেই ভাবেন এটি হয়তো চুলকানি বা অ্যালার্জির কারণে, কিন্তু আসলে মেলানোমা এমনভাবেই শুরু হতে পারে। তাই ত্বকে এমন পরিবর্তন হলে তা হালকাভাবে না নেওয়াই ভালো।
৪. নতুন তিলের উদ্ভব
প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে নতুন তিল বা দাগের উদ্ভবও সতর্ক সংকেত হতে পারে। বিশেষ করে যদি সেটি দ্রুত আকারে বাড়ে বা রঙ গাঢ় হয়।
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, ৩০ বছর বয়সের পর নতুন তিল দেখা দিলে তা অবশ্যই পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। কারণ এটি অনেক সময় মেলানোমার শুরু নির্দেশ করে।
৫. তিলের চারপাশে লালচে বা ফোলা ভাব
যদি কোনো তিলের চারপাশে লালচে বা প্রদাহজনিত পরিবর্তন দেখা দেয়, সেটিও একটি বিপদ সংকেত হতে পারে। এটি বোঝায় যে, কোষগুলো ত্বকের গভীরে ছড়িয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশে সাধারণত মানুষ এই পরিবর্তনকে ইনফেকশন বা গরমে র্যাশ মনে করে। কিন্তু যদি কয়েক সপ্তাহ পরও তা না সারে, তবে অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে।
৬. ত্বকে ব্যথা, জ্বালাপোড়া বা চুলকানি
যদি কোনো তিল বা দাগে ব্যথা, জ্বালা বা চুলকানি হয়, তবে সেটি মেলানোমার প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। বিশেষ করে যখন এই উপসর্গ হঠাৎ করে শুরু হয় এবং সময়ের সঙ্গে বাড়ে।
এই ধরনের জ্বালাপোড়া বা অস্বস্তি ত্বকের নিচে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে হয়। তাই এটি তুচ্ছ মনে না করে পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত।
৭. অসমান বর্ডারযুক্ত তিল
মেলানোমার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তিলের চারপাশের বর্ডার অনিয়মিত হওয়া। তিলের কিনারা যদি গোলাকার না হয়ে খসখসে বা ঢেউখেলানো হয়, তবে তা ক্যান্সারের ইঙ্গিত হতে পারে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটিকে বলা হয় “Asymmetrical Border”—যা প্রায় সব মেলানোমা রোগীর ত্বকে দেখা যায়।
৮. তিল বা দাগের রঙে পরিবর্তন
একই তিলে একাধিক রঙ দেখা গেলে (যেমন কালো, বাদামী, লালচে বা নীলচে), তা মেলানোমার ক্লাসিক লক্ষণ। কারণ ক্যান্সার কোষগুলো বিভিন্ন রঙের পিগমেন্ট তৈরি করতে পারে।
সাধারণ তিল সাধারণত এক রঙের হয়, তাই রঙ পরিবর্তন হলে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
৯. ত্বকের নিচে শক্ত গাঁট অনুভব হওয়া
কিছু ক্ষেত্রে মেলানোমা ত্বকের নিচে শক্ত গাঁটের মতো দেখা দেয়। এটি বোঝায় যে ক্যান্সার কোষ ত্বকের নিচের স্তরেও প্রবেশ করেছে।
এই গাঁটগুলো সাধারণত ব্যথাহীন হয়, কিন্তু সময়ের সঙ্গে বড় হতে থাকে। বাংলাদেশে অনেকেই এমন গাঁটকে ফোঁড়া বা ইনফেকশন মনে করেন, যা বিপজ্জনক ভুল।
১০. শরীরের অন্যান্য অংশে কালো দাগ ছড়িয়ে পড়া
যদি ত্বকের কোনো অংশ থেকে কালো দাগ শরীরের অন্য জায়গায় ছড়িয়ে যায়, সেটি মেলানোমার অগ্রসর স্তর নির্দেশ করে। এটি তখনই হয় যখন ক্যান্সার রক্ত বা লিম্ফের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
এমন অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা না হলে এটি প্রাণঘাতী হতে পারে। তাই দেরি না করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
উপসংহার
মেলানোমা স্কিন ক্যান্সার খুব ধীরে ধীরে শুরু হয়, কিন্তু দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই প্রথম লক্ষণ দেখলেই অবহেলা না করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে সূর্যের রশ্মি তীব্র, সেখানে সানস্ক্রিন ব্যবহার, হালকা পোশাক পরা এবং নিয়মিত ত্বক পরীক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যত তাড়াতাড়ি রোগ শনাক্ত করা যায়, তত বেশি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই নিজের ত্বকের প্রতি সচেতন থাকুন—একটি ছোট পরিবর্তনই আপনার জীবন রক্ষা করতে পারে।
